নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
“দুরন্ত শৈশব হারিয়ে যায় শিশুর শ্রমের যাতাকলে”
শিশু গৃহকর্মী কাজ করতে গিয়ে প্লেট ভাঙার অপরাধে মালিকের নির্মম নির্যাতন ; হোটেলের শিশু ওয়েটার গ্লাস ভাঙার অপরাধে মালিকের নির্যাতন ; শিশু শ্রমিক কাজে ভুল করায় বেঁধে অমানবিক নির্যাতন…….. এমনি বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত শিশুরা প্রতিনিয়ত কীভাবে নির্যাতনের শিকার হয়, সংবাদমাধ্যমে পায়শই এমন নির্মম সংবাদ প্রকাশ পেয়ে থাকে। দু’মুঠো খাবারের আশায় পরিবার-পরিজন ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যায় নীরবে। আর এসব কাজে একটু এদিক-সেদিক হলেই তাদের সহ্য করতে হয় শারীরিক নির্যাতন।
সরকার ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নির্ধারণ করে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের অঙ্গীকার করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকার বাসা-বাড়িতে প্রায় দেড় লাখ শিশু কাজ করে। এই শিশুরা সাধারণত গ্রাম থেকে আসে। শহরে গৃহকর্মে নিয়োজিত হওয়ায় তাদের নেই দুরন্ত শৈশব। আনন্দহীন জীবনে তাদের সামনে এক ধূসর ভবিষ্যৎ ছাড়া আর কিছুই নেই। পড়াশোনা তো দূরের কথা, অসুস্থ হলে চিকিৎসাও হয় না তাদের। সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু নানাভাবে শ্রম দিচ্ছে। এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে আট কোটি শিশু নানা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত।
যদিও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
এ পরিস্থিতিতে আজ বুধবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- ‘শিশুশ্রম নয়, শিশুর জীবন হোক স্বপ্নময়।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, আইএলও ঢাকা কার্যালয়, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে আলোচনা অনুষ্ঠান, বিশেষ প্রকাশনা, পোস্টার, লিফলেট বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে।
বিবিএসের হিসাবে বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু রয়েছে ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৫২ হাজার। জনসংখ্যার অনুপাতে শিশুর হার সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে, প্রায় ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপরই রয়েছে যথাক্রমে চট্টগ্রাম (২০ দশমিক ৬), রাজশাহী (১২ দশমিক ৫), রংপুর (১১ দশমিক ৩), খুলনা (১০ দশমিক ৫), সিলেট (৬) ও বরিশাল (৫ দশমিক ৩)।
শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরিয়ে আনার বিষয়ে ২০১৬ সালের প্রথম টার্গেট অর্জনে ব্যর্থ হয়ে আবারও ২০২১ সাল পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়। তবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শিশুশ্রম নিরসন নিয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নেই। আর এ বিষয় নিয়ে তেমন কোনো আলাপ-আলোচনাও নেই। এদিকে বাসাবাড়িতে নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা নিয়োজিত থাকলেও সরকারিভাবে ঘোষিত ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে গৃহকর্মকে রাখা হয়নি। শিশুর অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের নেতারা বলেন, জোরালো দাবি সত্ত্বেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় গৃহকর্মকে অন্তর্ভুক্ত করেনি সরকার। যে কোনো শ্রমই শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তারা।
মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘‘বাংলাদেশে অনেক ভালো আইন রয়েছে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ হয় না বলে সমাজের প্রায় প্রতিটি খাতে অবাধে শিশুশ্রম রয়েছে। আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান শিশুশ্রম বন্ধের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকার শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তত্ত্বাবধান করা হয় না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘শিশুশ্রম নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। শিশুর শ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণগুলো খোঁজা প্রয়োজন। অনেক পরিবার থেকে শিশুকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। শিশু বাধ্য হয় লেখাপড়া ছেড়ে কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এ ধরনের কারণ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’’
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ‘‘শ্রমজীবী শিশুদের অভিভাবকদের দারিদ্র্য দূরীকরণে বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ ও কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের সরিয়ে আনা হবে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ২৮৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনা হবে। বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত শিশুদের খুঁজে বের করে তাদের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ শেষে তাদের আত্মকর্মসংস্থানে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর শিশুশ্রমসংক্রান্ত কার্যক্রম মনিটরিং করছে এবং কোনো কারখানা মালিক শিশুদের নিয়োগ দিয়ে থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন খাতের কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে।’
সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে শিশুশ্রম নিরসনে জনসচেতনতা বেড়েছে বলেও উল্লেখ করেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী।