ঢাকা ০৩:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য কমিশনকে দায়ী করা যায় না : আদালতকে নুরুল হুদা

  • বার্তা কক্ষ
  • আপডেট সময় : ০৩:০০:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫
  • ৬৬ বার পড়া হয়েছে

{"remix_data":[],"remix_entry_point":"challenges","source_tags":["local"],"origin":"unknown","total_draw_time":0,"total_draw_actions":0,"layers_used":0,"brushes_used":0,"photos_added":0,"total_editor_actions":{},"tools_used":{"clone":1,"transform":2,"square_fit":1},"is_sticker":false,"edited_since_last_sticker_save":true,"containsFTESticker":false}

নিউজ ডেস্ক //অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে প্রহসনের নির্বাচন দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় করা মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা আদালতকে বলেছেন, বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য কমিশনকে দায়ী করা যায় না। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন কি না বিচারকের এমন প্রশ্নে ‘না’ সূচক জবাব দেন।

সোমবার (২৩ জুন) বিকেল ৩টার দিকে নুরুল হুদাকে আদালতে আনা হয়। এসময় তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। শুনানির আগে বিকেল ৪টা ৮ মিনিটে তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হয়।

এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপ-পরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন। আবেদনে তাকে রিমান্ডে নেওয়ার জন্য ১১টি কারণ উল্লেখ করেন।

রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফ্যাসিজমে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। পরে জনগণের হাতে ধরা পড়েন। জনগণের মৌলিক অধিকার, বাঁচার অধিকার, ভোটের অধিকার হরণ করেন। জনতা তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে উনাকে ফুলের মালা দিয়েছে। এরা সেদিন মানুষ ও জনতার পক্ষে থাকলে হাসিনা এত বড় ফ্যাসিস্ট হতো না। তার আমলে ২০১৮ সালে সবাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তারা জনগণ ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেন। নির্বাচনের সময় কমিশন ডিসি-ইউএনওদের অর্ডার দিয়ে রাতে ভোট দিয়েছেন। দিনের ভোট রাতে করার জন্য টাকা দিয়েছেন, বিরিয়ানি দিয়েছেন। অথচ সে বলেছে জনগণ ভোট দিয়েছে। কত বড় নির্লজ্জ হলে এমন কথা বলা যায়। এখনো তারা হাসে। আমার মনে হয় অন্য কেউ হলে নিজ থেকেই মরে যেত। আমরা তাকে চিনি নিশি রাতের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে। আমি জানি না, সে কীভাবে পরিবারের সামনে মুখ দেখায়।

আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট তৌহিদুল ইসলাম সজিব নুরুল হুদার রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, এখানে রিমান্ড শুনানিতে আইনের কথা বলা হয়নি, বরং আশেপাশের কথা বলা হয়েছে, আমরা সেগুলোতে যাব না। আসামির বিরুদ্ধে যেসব ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে সব ধারাই জামিনযোগ্য। প্রসিকিউশন বেছে বেছে জামিনযোগ্য ধারায় তার রিমান্ড চেয়েছেন, এটা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রসিকিউশনের উদ্দেশে তিনি বলেন, জামিনযোগ্য ধারায় রিমান্ড চাইতে পারবেন এমন আইন দেখান। এসময় উপস্থিত আইনজীবীরা চিৎকার শুরু করলে এজলাসে হট্টগোল সৃষ্টি হয়।

আসামিপক্ষের এ আইনজীবী শুনানিতে আরও বলেন, যেসব ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে তা আমাদের বিরুদ্ধে যায় না। এ মামলা আইনগতভাবে চলেই না। এটা ত্রুটিপূর্ণ এজাহার। আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী বলেন, নুরুল হুদা মহান মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরে মেজর জলিলের নেতৃত্বে সাব কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। তার নেতৃত্বে পটুয়াখালী জেলা হানাদার মুক্ত হয়েছে।

এরপর হুদার কোনো বক্তব্য আছে কি না জানতে চান বিচারক। এসময় বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি শপথ ভঙ্গ করেছেন মনে করেন কি না। উত্তরে তিনি ‘না’ বলেন। এসময় তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনে ৫টা লোক এবং তাদের সহযোগিতা করার জন্য ১৬ লাখ লোকের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করা। কোথায় কেমন নির্বাচন হচ্ছে ঢাকায় বসে দেখার সুযোগ নাই।

এরপর বিচারক আবারও তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি তো শপথ নিয়েছেন নির্বাচন ফেয়ার করার। তখন হুদা বলেন, নির্বাচন হয়ে গেলে, ফলাফল ঘোষণা হলে পরবর্তী কমপ্লিট জুরিসডিকশন হাইকোর্টের ওপর। হাইকোর্ট অনিয়ম পেলে পানিশমেন্ট দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। নির্বাচন হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশন সেটা বন্ধ করতে পারে না। এ ছাড়া পিপি বললেন নির্বাচনে টাকা দেওয়া হয়েছে, এগুলোর সুযোগ নাই। নির্বাচন যেটা বিতর্কিত হয়েছে, সেটার জন্য কমিশনকে দায়ী করা যায় না।

আধা ঘণ্টা ধরে পক্ষে-বিপক্ষে শুনানি শেষে আদালত নুরুল হুদার রিমান্ড বাতিলের আবেদন নামঞ্জুর করে চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আসামি করে রোববার (২২ জুন) রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করে বিএনপি। মামলায় মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহউদ্দিন খান বাদী হয়ে এ মামলা করেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০০৯ সালে তৎকালীন সামরিক শাসকদের সহায়তায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবৈধভাবে আওয়ামী লীগ ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তা পাকাপোক্ত করার জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি চালু ছিল তা বাতিল করান।

২০১৪ সালে শেখ হাসিনাসহ তার সরকার অবৈধভাবে শপথ নেওয়ার পর অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে তিনিসহ তার মন্ত্রিপরিষদ, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডাররা বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীদের অপহরণ, গুম, গুরুতর জখম, হত্যা ও বিভিন্ন উপায়ে নির্যাতন শুরু করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কে এম নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

সংসদ সদস্যদের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার মাধ্যমে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের অবৈধ সরকারের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ও একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কমিশন সংস্কারের পর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি জানায় এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে থাকে। বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা অঙ্গীকার করেন যে সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রতিষ্ঠার জন্য যা যা করা দরকার, তাই তিনি করবেন। তার এই আশ্বাসে বিএনপিসহ সব দল ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপিসহ বিভিন্ন দল মিলে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করতে গেলে অনেক জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের বাধার সম্মুখীন হয়।

বিএনপিসহ ঐক্য ফ্রন্টের প্রার্থীরা প্রচারণায় বের হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডারদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হন, গুরুতর জখম হন, গাড়ি ভাঙচুর হয় এবং ভোটের প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়। নির্বাচনে দলীয় সমর্থক ও নেতা-কর্মীরা মাঠে নামলে তাদের উপরও আক্রমণ, গুরুতর জখম, হত্যা, অপহরণ ও গুম শুরু হয়। একই কৌশলে সারা বাংলাদেশে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা তৈরি করে নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং বিএনপি সমর্থিত ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে এলাকা ছাড়া করা হয়। কোনো প্রকারেই ভোট প্রচারণায় বের হতে না পারায় বিএনপি ও ঐক্য ফ্রন্ট নির্বাচন পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য এবং এসব ঘটনার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিএনপির মহাসচিবের স্বাক্ষরিত চিঠির মাধ্যমে নুরুল হুদার কাছে আবেদন করে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, নুরুল হুদাসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররা নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সেই সময় কোনো প্রকার আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৭(এ) এর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে কেবল এই সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্ব দ্বারা কার্যকর করা হবে।’ এর অর্থ হলো রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, তাদের ক্ষমতাই সংবিধানের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। অথচ এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার মিলে সম্পূর্ণভাবে জনগণের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সংবিধানের পরিপন্থি কাজ করেছে এবং নির্বাচন সচিব ও নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মিলে এসব ঘটনায় কোনো প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি এবং নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনেননি। তৎকালীন অবৈধ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাসহ নির্বাচন কমিশনাররা পূর্ণ সহায়তা করে অবৈধভাবে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন সমাপ্ত করার পরিকল্পনা করেন।

নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররা ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্পূর্ণভাবে জনগণকে তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সংবিধানের পরিপন্থি কাজ করে এবং নির্বাচন আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিতদের দিয়ে দিনের ভোট রাতে করে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকালে কিছু ভোট আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডারদের মাধ্যমে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করে এবং বিএনপির ৬ জন সংসদ সদস্যকে বিজয়ী ঘোষণা করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে। নুরুল হুদা তার একক নির্দেশে দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নির্বাচনের ভোট কেন্দ্রে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে বাধা প্রদান করে। এই কাজের জন্য তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা গ্রহণ করেন।

একইভাবে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আসামি নুরুল হুদার প্রত্যক্ষ মদদে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ অন্যান্য আসামিরা আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন করে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।

ট্যাগস :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

আপলোডকারীর তথ্য

পিরোজপুরে বাস অটো মুখোমুখি সংঘর্ষে আহতদের হাসপাতালে খোঁজ খবর নেন জামাতে ইসলামির নেতৃবৃন্দ।

বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য কমিশনকে দায়ী করা যায় না : আদালতকে নুরুল হুদা

আপডেট সময় : ০৩:০০:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

নিউজ ডেস্ক //অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে প্রহসনের নির্বাচন দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় করা মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা আদালতকে বলেছেন, বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য কমিশনকে দায়ী করা যায় না। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন কি না বিচারকের এমন প্রশ্নে ‘না’ সূচক জবাব দেন।

সোমবার (২৩ জুন) বিকেল ৩টার দিকে নুরুল হুদাকে আদালতে আনা হয়। এসময় তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। শুনানির আগে বিকেল ৪টা ৮ মিনিটে তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হয়।

এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপ-পরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন। আবেদনে তাকে রিমান্ডে নেওয়ার জন্য ১১টি কারণ উল্লেখ করেন।

রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফ্যাসিজমে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। পরে জনগণের হাতে ধরা পড়েন। জনগণের মৌলিক অধিকার, বাঁচার অধিকার, ভোটের অধিকার হরণ করেন। জনতা তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে উনাকে ফুলের মালা দিয়েছে। এরা সেদিন মানুষ ও জনতার পক্ষে থাকলে হাসিনা এত বড় ফ্যাসিস্ট হতো না। তার আমলে ২০১৮ সালে সবাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তারা জনগণ ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেন। নির্বাচনের সময় কমিশন ডিসি-ইউএনওদের অর্ডার দিয়ে রাতে ভোট দিয়েছেন। দিনের ভোট রাতে করার জন্য টাকা দিয়েছেন, বিরিয়ানি দিয়েছেন। অথচ সে বলেছে জনগণ ভোট দিয়েছে। কত বড় নির্লজ্জ হলে এমন কথা বলা যায়। এখনো তারা হাসে। আমার মনে হয় অন্য কেউ হলে নিজ থেকেই মরে যেত। আমরা তাকে চিনি নিশি রাতের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে। আমি জানি না, সে কীভাবে পরিবারের সামনে মুখ দেখায়।

আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট তৌহিদুল ইসলাম সজিব নুরুল হুদার রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, এখানে রিমান্ড শুনানিতে আইনের কথা বলা হয়নি, বরং আশেপাশের কথা বলা হয়েছে, আমরা সেগুলোতে যাব না। আসামির বিরুদ্ধে যেসব ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে সব ধারাই জামিনযোগ্য। প্রসিকিউশন বেছে বেছে জামিনযোগ্য ধারায় তার রিমান্ড চেয়েছেন, এটা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রসিকিউশনের উদ্দেশে তিনি বলেন, জামিনযোগ্য ধারায় রিমান্ড চাইতে পারবেন এমন আইন দেখান। এসময় উপস্থিত আইনজীবীরা চিৎকার শুরু করলে এজলাসে হট্টগোল সৃষ্টি হয়।

আসামিপক্ষের এ আইনজীবী শুনানিতে আরও বলেন, যেসব ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে তা আমাদের বিরুদ্ধে যায় না। এ মামলা আইনগতভাবে চলেই না। এটা ত্রুটিপূর্ণ এজাহার। আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী বলেন, নুরুল হুদা মহান মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরে মেজর জলিলের নেতৃত্বে সাব কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। তার নেতৃত্বে পটুয়াখালী জেলা হানাদার মুক্ত হয়েছে।

এরপর হুদার কোনো বক্তব্য আছে কি না জানতে চান বিচারক। এসময় বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি শপথ ভঙ্গ করেছেন মনে করেন কি না। উত্তরে তিনি ‘না’ বলেন। এসময় তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনে ৫টা লোক এবং তাদের সহযোগিতা করার জন্য ১৬ লাখ লোকের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করা। কোথায় কেমন নির্বাচন হচ্ছে ঢাকায় বসে দেখার সুযোগ নাই।

এরপর বিচারক আবারও তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি তো শপথ নিয়েছেন নির্বাচন ফেয়ার করার। তখন হুদা বলেন, নির্বাচন হয়ে গেলে, ফলাফল ঘোষণা হলে পরবর্তী কমপ্লিট জুরিসডিকশন হাইকোর্টের ওপর। হাইকোর্ট অনিয়ম পেলে পানিশমেন্ট দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। নির্বাচন হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশন সেটা বন্ধ করতে পারে না। এ ছাড়া পিপি বললেন নির্বাচনে টাকা দেওয়া হয়েছে, এগুলোর সুযোগ নাই। নির্বাচন যেটা বিতর্কিত হয়েছে, সেটার জন্য কমিশনকে দায়ী করা যায় না।

আধা ঘণ্টা ধরে পক্ষে-বিপক্ষে শুনানি শেষে আদালত নুরুল হুদার রিমান্ড বাতিলের আবেদন নামঞ্জুর করে চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আসামি করে রোববার (২২ জুন) রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করে বিএনপি। মামলায় মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহউদ্দিন খান বাদী হয়ে এ মামলা করেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০০৯ সালে তৎকালীন সামরিক শাসকদের সহায়তায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবৈধভাবে আওয়ামী লীগ ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তা পাকাপোক্ত করার জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি চালু ছিল তা বাতিল করান।

২০১৪ সালে শেখ হাসিনাসহ তার সরকার অবৈধভাবে শপথ নেওয়ার পর অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে তিনিসহ তার মন্ত্রিপরিষদ, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডাররা বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীদের অপহরণ, গুম, গুরুতর জখম, হত্যা ও বিভিন্ন উপায়ে নির্যাতন শুরু করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কে এম নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

সংসদ সদস্যদের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার মাধ্যমে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের অবৈধ সরকারের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ও একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কমিশন সংস্কারের পর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি জানায় এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে থাকে। বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা অঙ্গীকার করেন যে সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রতিষ্ঠার জন্য যা যা করা দরকার, তাই তিনি করবেন। তার এই আশ্বাসে বিএনপিসহ সব দল ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপিসহ বিভিন্ন দল মিলে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করতে গেলে অনেক জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের বাধার সম্মুখীন হয়।

বিএনপিসহ ঐক্য ফ্রন্টের প্রার্থীরা প্রচারণায় বের হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডারদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হন, গুরুতর জখম হন, গাড়ি ভাঙচুর হয় এবং ভোটের প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়। নির্বাচনে দলীয় সমর্থক ও নেতা-কর্মীরা মাঠে নামলে তাদের উপরও আক্রমণ, গুরুতর জখম, হত্যা, অপহরণ ও গুম শুরু হয়। একই কৌশলে সারা বাংলাদেশে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা তৈরি করে নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং বিএনপি সমর্থিত ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে এলাকা ছাড়া করা হয়। কোনো প্রকারেই ভোট প্রচারণায় বের হতে না পারায় বিএনপি ও ঐক্য ফ্রন্ট নির্বাচন পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য এবং এসব ঘটনার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিএনপির মহাসচিবের স্বাক্ষরিত চিঠির মাধ্যমে নুরুল হুদার কাছে আবেদন করে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, নুরুল হুদাসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররা নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সেই সময় কোনো প্রকার আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৭(এ) এর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে কেবল এই সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্ব দ্বারা কার্যকর করা হবে।’ এর অর্থ হলো রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, তাদের ক্ষমতাই সংবিধানের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। অথচ এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার মিলে সম্পূর্ণভাবে জনগণের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সংবিধানের পরিপন্থি কাজ করেছে এবং নির্বাচন সচিব ও নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মিলে এসব ঘটনায় কোনো প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি এবং নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনেননি। তৎকালীন অবৈধ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাসহ নির্বাচন কমিশনাররা পূর্ণ সহায়তা করে অবৈধভাবে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন সমাপ্ত করার পরিকল্পনা করেন।

নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররা ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্পূর্ণভাবে জনগণকে তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সংবিধানের পরিপন্থি কাজ করে এবং নির্বাচন আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিতদের দিয়ে দিনের ভোট রাতে করে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকালে কিছু ভোট আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডারদের মাধ্যমে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করে এবং বিএনপির ৬ জন সংসদ সদস্যকে বিজয়ী ঘোষণা করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে। নুরুল হুদা তার একক নির্দেশে দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নির্বাচনের ভোট কেন্দ্রে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে বাধা প্রদান করে। এই কাজের জন্য তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা গ্রহণ করেন।

একইভাবে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আসামি নুরুল হুদার প্রত্যক্ষ মদদে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ অন্যান্য আসামিরা আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন করে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।