করোনা শনাক্ত ল্যাবটি শুরুতেই নানা সংকটে পড়েছে। শুরুতে ল্যাবে দেয়া পিসিআর মেশিন বিকল হওয়ায় বিকল্প হিসেবে যে মেশিনটি দেয়া হয়েছে তার কার্যক্ষমতা একেবারেই কম। তার ওপর টেকনোলজিস্টদের নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পিসিআর ল্যাবে কাজ করার জন্য এক শিফটের জন্য কম করে হলেও যেখানে ৩৬ জন টেকনোলজিস্ট দরকার, সেখানে কাজ করছেন মাত্র ৮ জন।
এর মধ্যে আবার ১ জন হাঁপানি ও একজন ডায়াবেটিস রোগী। আরেকজন আছেন যিনি গেল মাসে শরীরে কঠিন অপারেশন এবং টানা প্রায় দেড় মাস হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরেছেন। বলতে গেলে কোনোরকম ছুটি ছাড়াই একটানা কাজ করছেন টেকনোলজিস্টরা। কাজ শেষে ফিরে যাচ্ছেন বাড়িতে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী করোনাভাইরাস আক্রান্তদের খুব কাছে থেকে যারা কাজ করবেন তারা একদিকে যেমন বাড়ি যেতে পারবেন না, তেমনি কাজ করার পর নির্ধারিত একটা সময় পর্যন্ত তাদের আইসোলেশন অথবা কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। কিন্তু এই নিয়ম মানা হচ্ছে না এই ল্যাবে।
শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের একাডেমিক ভবনের দোতলায় মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে আরটি পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। ২৯ মার্চ ল্যাবের যন্ত্রপাতি ঢাকা থেকে এসে পৌঁছায়। এরপর ল্যাবটি চালু করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রথম দফায় আনা পিসিআর মেশিনটিতে জটিলতা দেখা দিলে সেটির বিকল্প হিসেবে আরেকটি মেশিন এনে বসানো হয় ল্যাবে। দ্বিতীয় দফায় বসানো এই মেশিনটির কার্যক্ষমতা তুলনামূলক অনেক কম। ফলে আশানুরূপ করোনা টেস্ট হচ্ছে না এই ল্যাবে।
বর্তমানে এই ল্যাবে ১২ জন ডাক্তার এবং ৮ জন ল্যাব টেকনোলজিস্ট কাজ করছেন। কর্মরত ডাক্তারদের মধ্যে ২ জন ভাইরোলজিস্ট, ১ জন মাইক্রোবায়োলজির এবং বাকিরা মেডিকেল অফিসার। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এক শিফটে সর্বোচ্চ ৯৪ জন রোগীর ড্রপলেট পরীক্ষা করা সম্ভব। এটি ৩ শিফট করা হলে আরও অনেক সন্দেহজনক রোগীর ড্রপলেট পরীক্ষা করা যেত। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না টেকনোলজিস্ট সংকটের কারণে।
শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে বর্তমানে টেকনোলজিস্ট রয়েছে মোট ১৩ জন। এদের মধ্যে নারী ৪ জন শুরু থেকেই রাজি হয়নি পিসিআর ল্যাবে কাজ করতে। বাকি ৯ জনের মধ্যে দায়িত্ব দেয়া হলেও মহিবুল্লাহ আনসারী নামে একজন টেকনোলজিস্ট প্রভাব খাটিয়ে ওপর মহলে তদবির করিয়ে পিসিআর ল্যাবের কাজে যোগ দেননি। বাকি ৮ জন কাজ করছেন এখানে। এই ৮ জনের মধ্যে তাহেরুল ইসলাম সুমন দীর্ঘদিন ধরে হাঁপানি রোগে ভুগছেন। এছাড়া আরেকজন টেকনোলজিস্ট ডায়াবেটিস রোগী।
ল্যাবের একজন টেকনোলজিস্ট বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনা রোগীর চিকিৎসা কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পর ১৪ দিন আইসোলেশন অথবা কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। আমাদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। কেবল এক শিফট প্রশ্নে ডব্লিউএইচও’র নিয়মানুযায়ী কাজ করতে গেলেও ৩৬ জন টেকনোলজিস্টের প্রয়োজন। অথচ এখানে রয়েছে মাত্র ৮ জন। তাও আবার ৩ জন অসুস্থ।
আরেকজন টেকনিশিয়ান বলেন, ‘এ জাতীয় সংক্রামক রোগের জীবাণু নিয়ে কাজ শেষে আইসোলেশন সেন্টারে থাকার কথা থাকলেও আমাদের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই কাজ শেষে বাড়িতে চলে যেতে হচ্ছে; যা পরিবারের জন্য খুবই বিপজ্জনক।’ জানতে চাইলে বরিশাল নাগরিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে টেস্টের আওতা বাড়ানো। অথচ এখানে পিসিআর ল্যাবে কাজ হচ্ছে এক শিফট। তাও আবার ৩৬ জনের জায়গায় মাত্র ৮ জন দিয়ে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক লোকবল দিয়ে ৩ শিফট করা হলে শনাক্তের সংখ্যা যেমন বাড়ত, তেমনি করোনা প্রতিরোধও সহজ হতো।’
শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. অসিত ভূষণ বলেন, ‘টেকনোলজিস্ট প্রশ্নে বড় একটা জটিলতায় আছি আমরা। কেবল বরিশাল নয়, পুরো দেশেই এই সমস্যা বিরাজ করছে। ২০১৩ সালে নিয়োগ নিয়ে দায়ের হওয়া একটি মামলার জেরে ৭ বছর ধরে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ। ফলে বিপুলসংখ্যক টেকনোলজিস্ট পদ শূন্য রয়েছে।
সূত্র: মতবাদ