শর্তময় ভালোবাসা
মোঃ সাইফুল ইসলাম।
শৈশবের দুরন্তপনা, খেলাধুলা আর আড্ডায় আড্ডায় কেটে যায় তুষারের বেশিরভাগ সময়। তুষার যখন ক্লাশ টু এর ছাত্র তখন থেকেই সে এতিম। বাবার ভালোবাসা বুঝে ওঠার সময়ও সে পায়নি। কারন বাবা যে কি জিনিস সেটা তুষার কখনো বুঝতে পারেনি। তার আগেই তার বাবা মারা গিয়েছে। মায়ের পরম স্নেহ ও বড় ভাইদের ভালোবাসাতেই তার জীবন চলা শুরু। কখনো কোন দুঃখ-কষ্ট সে অনুভব করেনি।
পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে আপন নিয়মে। যতটুকু দরকার ততটুকুই সে করছে। খেলাধুলা নিয়মিত চলছে ফুটবল,ক্রিকেট,ব্যাডমিন্টন,কেরামবোটসহ যতপ্রকার খেলাধুলা আছে সবগুলোতেই সে পারদর্শী । ছোট তুষার নিরবে নিভৃতেই বড় হয়ে উঠছে। কোন জৌলুস নেই, নেই কোন বাড়াবাড়ি। মিডিয়াম স্টুডেন্ট বলতে যা বুঝায় সে অনেকটা তাই। কারন অনেক বেশি পড়াশোনা সে কখনোই করেনি। তাই সে ক্লাশে কখনো ফাষ্ট বয়ও হয়নি। আবার একেবারে হতাশ করার মত ছাত্রও সে ছিলো না।
জীবনের এক লম্বা সময়ে পাড়ি দিয়ে তুষার এখন এস.এস.সি পরীক্ষার্থী। পরিক্ষা শুরু হলো, আপন মনে সে স্বপ্ন বুনতে শুরু করলো । সবগুলো পরিক্ষা খুবই ভালো দিলো কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞান পরিক্ষার নৈবত্তিকে ৩৫টি প্রশ্নের ২০টি প্রশ্নেই ৪টি করে ভরাট করে আসলো। অবশ্য এতে তার তেমন কোন দোষ ছিলোনা তাদের স্কুলের এক শিক্ষক পিছনে বসা হৃদয়কে বলে দিচ্ছিলো যেটা না পারো ৪টি করে ভরাট করে আসো। কারন নৈর্বত্তিক খাতা কম্পিউটারে দেখে সুতরাং যেটা সঠিক সেটাই সে নিবে। ভূলগুলো কম্পিউটার নিবে না।
কিন্তু, এর ফল তুষারকে একবছর লস দিয়েই দিতে হলো। সে ঐ বছর পদার্থ বিজ্ঞান পরিক্ষার নৈর্বত্তিকে ১০ পেল। যদিও ১৩ পেলে পাশ হয়ে যেতো। শুধু পাশ নয় স্টার মার্ক পেয়েই পাশ হয়ে যেতো।
পরবর্তীতে সবগুলো পরিক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সাথে পাশ করলো তুষার। কিন্তু পাশ করলেও তার আতংক কাটেনি। একবার খারাপ করলে তার কনফিডেন্স লেভেল অনেক নীচে নেমে আসে। তুষারের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হলো না। তাই গ্রুপ পরিবর্তন করেই কলেজে ভর্তি হলো।
জীবন চলে জীবনের নিয়মে। প্রকৃতি চলে প্রকৃতির মতই। প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম পরিবর্তন করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তুষারও এর ব্যতিক্রম নয়। যত দিন যায় সুখের দিনগুলো ততই আস্তে আস্তে বিষন্নতা ও হতাশায় পরিবর্তিত হতে শুরু করলো।
ভাইদের বিয়ের পরে তাদের ভালোবাসায় একটু কমতি শুরু করলো। পড়াশুনার খরচ নিজেকে বহন করতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দিলো বড় ভাই। অগত্যা প্রাইভেট পড়িয়ে টাকা রোজগারের ব্যবস্থা শুরু করতে হলো তুষারকে। বেশ কয়েকজন ছাত্র/ছাত্রী ছিলো তার। তিন বন্ধু মিলে তারা একটি কোচিং সেন্টারও দিয়েছিল । ভলোই চলতে ছিলো তার এই জীবন যুদ্ধ। এভাবে করেই সে এইচ,এস,সি ও পাশ করে গেল।
শুরু হলো ভার্সিটি লাইফ। অনার্সে ভর্তি হয়ে নিয়মিতভাবে ক্লাস করা লাইব্রীরেতে বসে নোট করাসহ ভালো ভাবেই সে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু বিধিবাম, বছর শেষে গত বছরের প্রাইভেটগুলোর মধ্যে অহনা ও তার ভাই হৃদয়ের বাড়ি থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিলো না। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারী শেষ হয় তারপরেও কোনা খবর নেই। তুষার একদিন অহনাদের বাড়িতে খোঁজ নেয়ার জন্য গেলো। কারন অহনাদের গত বছরের বেতন বকেয়া ছিলো এবং অহনার মা বলেছিলো আগামী বছর পড়াতে এসে একসাথে সব বেতন নিয়ে যাওয়ার জন্য। আসলে অনেকগুলো প্রাইভেটের ভিতরে কিছু কিছু প্রাইভেট স্পেশাল থাকে। তেমনি অহনাদের এই টিউশনটাও নিরবের স্পেশাল ছিলো। তুষারের পড়াশুনার সমুদয় খরচ এই টিউশন থেকেই চলতো। যারা নিয়মিত বেতন দিতো মূলত তারাই একটু স্পেশাল হয় । এছাড়া স্পেশাল হতে হলে প্রতিদিন নাস্তা, গার্ডিয়ানের আচার-ব্যাবহারসহ আরো অনেকগুলো উপাদান জড়িত থাকে। সেদিক থেকে অহনারাই পারফেক্ট ছিলো। তাই তাদের প্রতি যেমন সফ্টকর্নার বেশী ছিলো তেমনি প্রত্যাশাও ছিলো অনেক বেশী।
কিন্ত তুষারের কাছে সেদিন অহনার মা বললো তারা স্কুলের মাহমুদ স্যারের কাছে পড়াবে আপাতত বাসায় টিচার লাগবে না। এ কথা শুণে তুষার অসম্ভব রকমের মনে কষ্ট পেলো। সে বাসায় ফিরে আসলো এবং প্রতিজ্ঞা করলো আর গ্রামে থাকবেই না। যেমন ভাবা তেমনি কাজ, যতগুলো টিউশন ছিলো সবগুলো বাদ দিয়ে একদিনের মধ্যে সে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেলো।
শহরে উঠতে গিয়েও কিছুটা হতাশা ছিলো। তুষারের বন্ধু মিজান একটি বাসা ঠিক করে দেয়ার কথা বলেছিলো। কিন্তু যখন তুষার বাড়ি থেকে চলে আসলো তখন আর মিজান কে যথাসময়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই সেখান থেকেও একটু মনোক্ষুণ্ণ হয়ে সে সোঁজা খালাতো ভাইয়ের কাছে চলে গেলো।
শুরু হলো নতুন অধ্যয়, শহুরে জীবন। শহুরের প্রতিটি মুহুর্ত ছিলো চ্যালেঞ্জিং। প্রতিটি মুহুর্ত যুদ্ধ করে বাঁচতে হতো। দিক্বিদিক না পেয়ে সে খালাতো ভাইয়ের সাথে ব্যাচেলর বাসাতে গিয়েই উঠলো। যেহেতু পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে আসা হয়নি। তাই থাকা খাওয়া বিশেষ করে থাকার জন্য মেসের অন্যান্যদের সাথে একটু ঝামেলায় পড়তে হয় ভাইয়াকে। সবকিছু ম্যানেজ করে থাকা শুরু করলো তুষার। খালাতো ভাই অল্প সময়ে কয়েকটা টিউশন এবং খাবারের জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা করে দিলো।
যেহেতু মা বাড়িতে একা সেহেতু প্রতি সপ্তাহেই তুষারকে বাড়িতে যেতে হতো। তাই সপ্তাহে বৃহস্পতিবার বিকালে বাড়িতে যেতো এবং শনিবার শহরে ফিরে আসেতো। এভাবে কিছুদিন আসাতে আগের পরিচিতজন যারা আছেন তারা তাদের সন্তানদের কে পড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন। তুষার তাদের সবাইকে সাফ না করে দিলো। কিন্তু স্বপ্না ও স্নেহার বাবার জোর আপত্তিতে পড়াতে রাজি হলো। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, শুক্রবার সকালে ও শনিবার সকাল বেলা পড়িয়ে সে চলে আসে।
স্বপ্না ও স্নেহার আর একটি ছোট ভাই আছে রিয়াদ। সেও মাঝে মাঝে আদর্শলিপি পড়তে আসে। এভাবেই মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে। হটাৎ ওদের দাদী অসুস্থ হয়ে গেল এবং দীর্ঘদিন বাসায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলো। তার পুরো যত্ন ওর মা করেছে। এটা তুষারের মনে দাগ কেটেছে। তুষার মনে মনে ভাবলো তার মাও তো তার জন্য জীবনে অনেক সেক্রিফাইজ করেছে। তার বুড়ো বয়সে যদি এমন যত্ন করার একজন মানুষ থাকে তাহলে খারাপ হতো না। এমন ভাবনাগুলো তুষারের মনে চলতে ছিলো। সাথে স্বপ্নাও স্যারকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলো।
কিন্ত তুষার যখন অনার্সে পড়ে স্বপ্না তখন ক্লাশ এইটে। দু’জনের বয়সের পার্থক্য একটু বেশীই ছিলো।( চলমান……..)